ছোটবেলায় যত পাকনামী..................................




(ছোটবেলায় যত পাকনামী করেছি, তার প্রমাণ খুব বেশি নেই, এই একটা রয়ে গেছে। পুরনো ডাইরী ঘাটাঘাটি করে বের করলাম সেদিন। মাত্র ক্লাস ফোরে উঠেছি তখন। খুবই নিম্নমানের লেখা, তবু ঐ বয়সে যে লিখেছি এটা মনে করলেই মজা পাই। কোনরকম পরিবর্তন না করে দিয়ে দিলাম।)


শিবাটা এরকমই। কেউ তার সাথে জোরে কথা বললেই বলবে, "তাহলে আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাব। আর আসব না।" যদি জিজ্ঞেস করা হয়, "কোথায় যাবি?" তো বলবে, "পোড়োবাড়ী, যে বাড়ীতে ভূতেরা থাকে।" আসলে তো কোথাও যাবে না, খালি মুখেই ফটর ফটর। আচ্ছা, শিবার এরকম করার কারণটা কী? ওকে তো আর কেউ মারধর করে না। বাড়ীর বড় মেয়ে, ওর গায়ে কি হাত তোলা যায়?...................................................................

আমি ওর মামা। তাও যদি একটু সম্মান করে কথা বলে। যদিও ওর চেয়ে মাত্র দুই বছরের বড় আমি। তাই বলে কি তুমি করে বলতে হবে? আমি তো সমবয়সী কিংবা ছোট নই। আপনি করে বলতে বললে ঠোঁট ফুলিয়ে সামনে থেকে সরে যাবে। আচ্ছা এটা রাগের কোন কারণ হল? ওর কলেজের বান্ধবীরা ওর সাথে কথা বলে যে কী করে, আমার মাথায় আসে না। ওরাও মনে হয় এরকমই।

কাল আবার সে নতুন কথা শোনাল। সে নাকি পোড়োবাড়িতে গিয়ে ভূতেদের সঙ্গে গান গাইবে। আপা বললেন, "শুধু গান গাবি? নাচবি না?" সঙ্গে সঙ্গে শিবা এক গামলা অশ্রু ফেলে চলে গেল নিজের রুমে। নিশ্চয়ই দরজা আটকিয়ে অনশন ধর্মঘট শুরু করবে। তা এখানে কেন? প্রেসক্লাবের সামনে গিয়ে করলেই পারে। শেষে আমি যখন বললাম, "তোর ঐ গল্পের বইটা না আমি পড়ার জন্য চুরি করে নিয়েছিলাম, তারপর তোর ঘরে আবার রেখে দিয়ে আসতে ভুলে গেছি।"

সঙ্গে সঙ্গে সে হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে পড়ল। বলল, "কোথায় আমার বই? শিগগির বের কর।" আমি আমার শার্টের ভিতর থেকে বের করে দিয়ে দিলাম। আর ও সেটা ওর কাপড়ের আলমিরায় ঢুকিয়ে চাবি দিয়ে দিল। বইটা হুমায়ূন আহমেদের। ওর প্রিয় লেখক। আমাকে বইগুলো ধরতেই দেয় না। আমি অবশ্য সবগুলো পড়েছি, লুকিয়ে লুকিয়ে। বইটা ঢুকিয়ে সে বলল, "আমার বই তুমি চুরি করেছিলে কেন?" আমি বললাম, "তোর বই না, হুমায়ূন আহমেদের বই।" শিবা চোখ পাকিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।

আজ শিবার মেজাজটা ভালো আছে। কোনরকম কথা কাটাকাটি হচ্ছে না। তবে হয়ে যাবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। একটু আগে সে আমার কাছে একটা প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল, গল্প লেখার। দুইজনের দুটা গল্প লিখব। যারটা বেশি ভালো হবে, অন্যজন তাকে কিছু একটা উপহার দিবে। প্রস্তাবটা ভালোই। আমি রাজি হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সাদা কাগজ সামনে নিয়েই বসে আছি। অবশেষে এক পৃষ্ঠা লিখলাম। পৃষ্ঠা শেষ হতে না হতেই দেখি শিবা কাগজপত্র নিয়ে হাজির।

-"কী রে, তোর লেখা শেষ?"
-"আরে না, তিন পৃষ্ঠা লিখেছি। দেখতে এলাম তুমি কতদূর এগিয়েছ।"
-"আমি তো মাত্র এক পৃষ্ঠা লিখেছি। তুই কী লিখেছিস দেখি। আমারটা তুই দেখ।"

কিছুদূর পড়ে আমি বললাম,
-"তুই কী করেছিস রে। গল্পের শুরুতেই নায়ককে মেরে ফেলেছিস যে।"
-"তুমি একটা আহাম্মক। নায়ক মারা যাবার পর নায়িকা কিভাবে জীবন কাটাচ্ছে সেটাই হচ্ছে গল্পের মূল বিষয়।"
-"আচ্ছা ঠিক আছে। তা না হয় বুঝলাম। কিন্তু তুই নায়ককে মারলি কেন? নায়িকাকে মারতি। এখন তো নায়িকাকে বিষ খাওয়াতে হবে। নায়ক হলে আরেকটা বিয়ে করত, বুঝলি?"
-"হয়েছে হয়েছে। আমাকে গল্প লেখা শেখাতে হবে না। তুমি কী লিখেছ? একটা থার্ডক্লাস গল্প"।

এর পর আরও কী সব বলতে বলতে গজ গজ করতে করতে ভুল করে আমার গল্পটা নিয়ে গেল আর নিজেরটা রেখে গেল। এই তো সুযোগ, এইবার আমাদের শিবামনির গল্পটা সুন্দর করে সাজিয়ে তুলি। লিখে দিলাম, নায়ক মারা যাবার নায়িকা খুব খুশী। এতদিনে আপদটা বিদায় হয়েছে। সে আরেকটা বিয়ে করল, ইত্যাদি ইত্যাদি।

লেখা শেষ করে নিয়ে গেলাম সোজা দুলাভাইয়ের কাছে। "দেখুন দুলাভাই, শিবার সাহিত্যকর্ম।" দুলাভাই পড়ে হঠাৎ ঘর কাঁপিয়ে হাসতে শুরু করলেন। শিবা মনে হয় দুলাভাইয়ের কাছ থেকেই 'ছিট' জিনিসটা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে।

যাক সে কথা, দুলাভাইয়ের হাসির চমকে দমকে সমস্ত বাড়িতে আমার ক্রিয়া-কলাপের কথা ছড়িয়ে পড়ল। শিবা তো রেগে টং। বলল, "দাঁড়াও এখুনি তোমার গল্পের বারোটা বাজাচ্ছি।" বলেই সে আমার গল্পের কাগজটা শত টুকরো করে ড্রেনে ভাসিয়ে দিল। আচ্ছা, কাগজটা টুকরো টুকরো না হয় করল, ড্রেনে ভাসাবার কী দরকার ছিল? এর চেয়ে যদি বাতাসে উড়িয়ে দিত, তাহলে তার থেকে কোন একটা টুকরা কোন মহৎ ব্যক্তির বাড়ির ছাদে গিয়ে পড়ত, আমার জীবনটা হয়ে যেত ধন্য।

না, আর সহ্য করতে পারছি না। রাগের চোটে বলে দিলাম, "শিবা তো নয়, একটা আস্ত গবা।" ব্যস হয়েছে, এক্ষুণই নিশ্চয় ঘরে গিয়ে দরজা আটকে বসে থাকবে। ঘরে সে গেল ঠিকই, কিন্তু একটু বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলল। বিশটা ঘুমের বড়ি গিলে ফেলল। তাড়াতাড়ি করে শিবাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। স্টমাক ওয়াশ করে যখন শুইয়ে রাখা হল, আমি দেখা করতে গেলাম।

এমন শান্ত-শিষ্ট মেয়ে পৃথিবীতে দুটি আছে কি না সন্দেহ হচ্ছে। শিবাটা কি সত্যিই বদলে গেছে নাকি। আমাকে দেখে বলল, "মামা, আমাকে মাফ করে দিবেন, আপনার গল্পটা খুব সুন্দর হচ্ছিল। আপনি আবার লিখুন, লিখে শেষ করুন, আমি শর্ত মোতাবেক আপনাকে উপহার দিব।"

আমি জানালা দিয়ে আকাশ দেখবার চেষ্টা করলাম, সূর্যটা কি আজ পূর্বদিকেই উঠেছে? নাকি ভুল করে.................।

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন